মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা জেলার ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় সাতক্ষীরার সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ মুক্তির আকাঙ্খায় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন মরণ যুদ্ধে । | ||||||
১৯৭১-র ২৫ মার্চ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন দাবীতে। ২ মার্চ পালিত হয় হরতাল, ৩মার্চ ছিল বিক্ষোভ দিবস । এদিন পাকিস্তানি দোসরদের গুলিতে সাতক্ষীরাতে নিহত হয় রিকশা শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক । আহত হয় আরও অনেকে । স্বাধীনতা আন্দোলনে সাতক্ষীরারপ্রথম শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের নামানুসারে পরবর্তীতে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চিলড্রেন পার্কটিকে ‘শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক’ নামকরণ করা হয়েছে । ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সাতক্ষীরার মানুষ সেভাষণ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে ছিল। ৮ মার্চ সকাল ৮:০০ টার সংবাদের পররাস্তার বিভিন্ন মোড়ে হাটে-বাজারে রেডিও নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সাতক্ষীরারমানুষ সমবেত হয়ে এই ভাষণ শোনেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরাতেও শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ।মুক্তিযুদ্ধের এই প্রস্তুতিলগ্নে সাতক্ষীরাতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য দুটো ঘটনা নিম্নে বর্ণনা করা হলো |
সহযোদ্ধাকে যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে বিদায় জানাচ্ছেন বাশুন্দিয়া ক্যাম্পের অধিনায়ক সুলতান উদ্দিন আহমদ |
|||||
সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে অস্ত্র সংগ্রহ : | ||||||
খুলনা ও যশোর শহর পাকবাহিনী কর্তৃক দখলের পর সাতক্ষীরা গমনের প্রস্তুতি নেয় তারা । তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হলে অস্ত্রের প্রয়োজন । আর সে কারণেই এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ( ১৪ থেকে ১৭ তারিখের মধ্যে) সাতক্ষীরা সংগ্রাম পরিষদ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ । এ কাজে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় । অস্ত্র ও গুলি পেয়ে সংগ্রাম পরিষদ নেতা-কর্মীদের মনোবল বেড়ে যায় । | ||||||
ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন : | ||||||
১৯ এপ্রিল গভীর রাতে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম.এন.এ) আবদুল গফুর (পাইকগাছা) ও ইপিআর সুবেদার আইয়ুব আলির নেতুত্বে একদল সশস্ত্র ইপিআর জোয়ান ও কতিপয় সংগ্রামী যুবনেতা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সাতক্ষীরা শাখা (বর্তমান সোনালী ব্যাংক) অপারেশন করে সংগ্রহ করে ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা । মুক্তিযুদ্ধের খরচ মিটানোর জন্য সাতক্ষীরায় ব্যাংক অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । উক্ত টাকা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের বসিরহাট শাখায় জমা করা হয় ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মু্ক্তিযুদ্ধকে ব্যাপক ও জোরদার করার উদ্দেশ্যে রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে অধিনায়ক নিযুক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল । |
সাতক্ষীরা রোডের উপর বিধ্বস্ত কয়েকটি পাকসেনাদের কেরিয়ার |
|||||
সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল অষ্টম ওনবম সেক্টরের অধীন । এছাড়া নবম সেক্টরের আওতায় ছিল ‘সাতক্ষীরা-দৌলতপুর সড়কসহ খুলনার দক্ষিণাঞ্চল এবং বরিশাল ও পটুয়াখালি জেলা ।’ | ||||||
বিভিন্ন সময়েদায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমাণ্ডারগণ: | ||||||
১. মেজর এম.এ জলিল | ||||||
২. মেজর জয়নুল আবেদিন | ||||||
৩. আবু ওসমান চৌধুরী | ||||||
৪. মেজর এম.এ মনজুর | ||||||
সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন নবম সেক্টরে বেশ কয়েকজন সাব সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়, তাঁরা হলেন : | ||||||
১. ক্যাপ্টেন শফিকুল্লা | ||||||
২. ক্যাপ্টেন মাহবুব আহমেদ | ||||||
৩. মোহাম্মদ শাহজাহান (ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার নামে খ্যাত) | ||||||
৪. ক্যাপ্টেন এম.এন হুদা | ||||||
৫. ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন | ||||||
৬. লে. মাহফুজ আলম বেগ | ||||||
৭. লে. সামসুল আরেফিন | ||||||
সাতক্ষীরা মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান, আশাশুনি থানা দখল ও পন্টুন ধ্বংস | ||||||
কমান্ডো মো: খলিলুর রহমান | ||||||
বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত থানা আশাশুনি জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এর পশ্চিম পাশে ভারতীয় সীমান্তে দেবহাটা ও কালিগঞ্জ থানা এবং পূর্ব দিকে খুলনা জেলার পাইকগাছা থানা অবস্থিত। সেই সময় সাতক্ষীরা সদর থেকে একটি আধা-কঁাচা পাকা রাস্তা আশাশুনি পর্যন্ত ছিলো। এছাড়া নদীপথেও সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনি পর্যন্ত যোগাযোগ সুগম ছিলো । শত্রুসেনাদের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য পাকিস্তান নেভীর অফিসারদের ফান্সে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পালিয়ে আসা সাবমেরিনার লে: গাজী মো. রহমতউল্লাহ (বর্তমান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম খুলনা বিভাগীয় সভাপতি) মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের সাথে পরামর্শ করে প্রথমে আশাশুনি এবং বিপরীত তীরে চাপড়ার স্বাধীনতা বিরোধী আতিয়ার ও মতিয়ারের অবস্থিত রাজাকার ও মিলিশিয়া এবং বাঙালী পুলিশদের শত্রুঘাটি দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । লক্ষ বাস্তবায়নের জন্য তিনি প্রথমে আশাশুনি থানা আক্রমন করে শত্রুবাহিনীর শক্তি নিরীক্ষা করতে চাইলেন । |
|
|||||
শত্রু বাহিনীর অবস্থান: | ||||||
আশাশুনি থানা এবং এর পার্শ্ববর্তী নদীর বিপরীত তীরে চাপড়া গ্রামে পাক বাহিনীর দূর্গম ঘাটি ছিলো। এখানে রেঞ্জার্স, রাজাকার, পুলিশ মিলিয়ে দুই কোম্পানী সৈন্য অবস্থান করতো। এলাকাটি সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত হওয়ায় এর নিরাপত্তার দায়িত্বভার ছিলো ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্টের ওপর । এছাড়া ২১ পাঞ্জাব সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ায় অবস্থান করছিল । এর সাথে শক্তি বৃদ্ধির জন্য তারা স্থানীয়ভাবে প্রচুরসংখ্যক রাজাকার ভর্তি করে | ||||||
সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী হওয়ায় উভয়পক্ষের কাছে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম । বিশেষভাবে জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের থানাগুলো এবং পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের অনুকূলে রাখার জন্য উভয়পক্ষের মাঝে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ লেগে থাকত । সুন্দরবনের অভ্যন্তরেনদীপথ দিয়ে বাংলাদেশের মধ্যভাগে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোর জন্য ছিল সর্বোত্তম পথ । এ পথের গতি রোধ করার জন্য অসংখ্য গানবোট সার্বক্ষণিক টহল নিয়ে বেড়াতো। এই গানবোটের অনেকগুলো নৌকমান্ডোদের হাতে ঘায়েল হয়েছে । পাকিস্থানীরা নৌকমান্ডোদের অপ্রতিরোধ্য গতিকে কখনো স্তিমিত করতে পারেনি ।ফলে সংঘটিত হয়েছে বার বার যুদ্ধ । | ||||||
যুদ্ধের বর্ণনা : | ||||||
মংলা এবং চালনার নদীবন্দরে বার বার জাহাজ ডুবির ফলে পাকিস্তানী বাহিনী যেমন সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে, সাথে নিরাপত্তার জন্য তারা নদীতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে । শত্রু বাহিনী স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীণ বৃহ.. লঞ্চ রিকুইজিশন করে সেগুলোকে খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে কিছু রুপান্তর করে ৫ কিলোমিটার কামান ও হেভী মেশিনগান বসিয়ে গানবোটে রুপান্তর করে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে লাগায় । স্থলভাগেও হানাদার বাহিনী কম্বিং অপারেশন শুরু করে । ফলে নৌকমান্ডোদের কৈলাশগঞ্জ থেকে তাদের আশ্রয়স্থল বদল করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সরে যেতে বাধ্য হয় ।
|
|
|||||
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এ এলাকায় সেনাশক্তি বৃদ্ধির জন্য সাবমেরিনার ও নৌপ্রশিক্ষণ ঘাটির অন্যতম সংগঠক লে: গাজী মো: রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে আরো ৩০জন নৌকমান্ডোসহএকটি মুক্তিযোদ্ধা দল মংলা এলাকায় পাঠানো হয় । পূর্ব দলের সাথে এই দলের সমন্বয় এবং স্থল যোদ্ধাদের সাথে সমন্বিত হওয়ায় খুলনার দক্ষিণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি অনেকগুনে বেড়ে যায় । গড়ে ওঠে একটি বৃহ.. মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন । অত:পর গাজী রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে ছাত্র নেত্রীবৃন্দ সমন্বিত যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সাতক্ষীরা ও খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে শত্রুঘাটি একের পর এক মুক্ত করতে থাকেন । | ||||||
সেই সময়ে আশাশুনি থানায় রাজাকারদের শক্তি এবং অত্যাচার বহুগুনে বেড়ে যায় । ফলে এই সমন্বিত বাহিনী আশাশুনি থানা দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আশাশুনি থানা দখলে আনা সম্ভব হলে সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণাঞ্চল মুক্ত অঞ্চলে পরিনত হবে । এতে এলাকায় তঁাদের গতি অবাধ ও নির্বিঘ্ন হবে । সে অবস্থায় মংলাসহ অন্য নৌবন্দরগুলোতে নৌকমান্ডদের অপারেশন চালানো অনেক সহজ হবে, এমন মনে করে সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধা ও নৌকমান্ডো বাহিনী আশাশুনি থানা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন । এই উদ্দেশ্যে যাবতীয় পরামর্শ এবং প্রস্তুতি শেষ করে ৬ অক্টোবর রাতে সম্মিলিত আক্রমন চালানো হয় আশাশুনি থানার ওপর ।
কিন্তু শত্রুবাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে এখানে থানার ছাদসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন বাড়ির ছাদেও সুরক্ষিত বাঙ্কার বানিয়ে রেখেছিল । সারারাত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এগারোজন যোদ্ধঅ মারাত্নকভাবে জখম হয় । সেদিন প্রচন্ড যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর সামছুল আরেফিন, লে: গাজী মো. রহমতউল্লাহ, খিজির আলী, কামরুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী ও শেখ আ. কাইয়ুম। |
||||||
প্রথম দিনের যুদ্ধে তানা দখল সম্ভব না হলেও মুক্তিবাহিনী নেতৃবৃন্দ নিরাশ না হয়ে পরিকল্পিতভাবে পরদিনই আবার আশাশুনি থানায় আক্রমণ পরিচালনা করেন । এদিন নৌ-কমান্ডোরা জীবনের ঝুকি নিয়ে অপর পারে থানার ঘাটে ভাসমান ফেরি পণ্টুনে ৪টি মাইন বিস্ফোরণ ঘটান । প্রলয়ংকরী শব্দে ৩-৪টি মাইনের বিস্ফোরণ ঘটায় সমগ্র ফেরীঘাট তছনছ হয়ে যায় । এক একটি লোহার পাত ৫০-১০০ গজ দুরে ছিটকে পড়ে । নদীর পানি পাহাড়ের মতো রুপ নিয়ে ৩০ খেবে ৪০ ফুট ওপরে ওঠে । এই দৃশ্য দেখে শত্রু সৈন্য এবং রাজাকার অবস্থান ছেড়ে পালাতে থাকে । ১১ জন পাকসেনা এবং ৪০ জন রাজাকার নিহত হয় । মুক্তিবাহিনী ৪ দলে বিভাক্ত হয়ে থানা আক্রমণ করে । ফলে দখলদার বাহিনী ও রাজাকার যারা থানা এবং বাঙ্কারে ছিল, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে । কমান্ডো জিএমএ গফ্ফারের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল আশাশুনি-সাতক্ষীরা সড়কের মাঝে একটি ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে কাট অফ পার্টির দায়িত্ব পালন করেন । মুক্তিবাহিনীর সদস্য খিজির আলী এই যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর সামনেই দন্ডায়মান অবস্থায় দুটি এল.এল.জি বগলে চেপে গুলি ছুড়তে ছুড়তে থানায় গিয়ে ওঠেন । রাজাকার এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা তার ভয়াল মূর্তি দেথে অস্ত্রশস্ত্র ফেলেই পালাতে শুরু করে । এদিন আশাশুনি থানার পতন ঘটে। পাকবাহিনী পালিয়ে সাতক্ষীরা সদরে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সালিক এই সাফল্যের জন্য রহমতউল্লাহ সাহেবকে অভিনন্দিত করেন । উল্লেখযোগ্য, ব্রিগেডিয়ার সালিক তাকে রণাঙ্গনে পাটিয়েছিলেন । পরদিন পাকিস্তানী বাহিনী হেলিকপ্টার নিয়ে এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ শুরু করে । পাকবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ও বোমা ফেলতে থাকে । ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটে সুন্দরবনে আশ্রয় নিতে হয় । আশাশুনি থানার পতন হলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাঙ্গার থেকে ১০-১২ জন বাঙালি যুবতীকে উদ্ধার করে। এই যুদ্ধে ৪০জন রাজাকার বন্দি হয় । | ||||||
এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন : | ||||||
সাবমেরিনার লে: গাজী মো. রহমতউল্লাহ, মেজর সামছুল আরেফিন, খিজির আলী, স ম বাবর আলী, কামরুজ্জামান টুকু, শেখ আ. কাইয়ুম, কমান্ডো বজলুল রহমান, আবদুস সাত্তার, জহুরুল হক, কামরুল হুদা, শাহাদাত হোসেন, রমেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্র, আ. কাদের, আবুল হোসেন, সৈয়দ আক্রাম, খলিলউল্লাহ, আলফাজউদ্দিন, সুবোধ বিশ্বাস, আ.হক, জিএম আ. রহিম, মাহফুজুল হক, জিএমএ গফ্ফার, বিশ্বনাথ পালিত, আ. গফুর, সুশীল কুমার, সুবোধ কুমার, দিলীপ কুমার রায়, আলফাজ উদ্দিন, শফিক, জবেদ আলী, আশরাফ, প্রফুল্ল কুমারসহ ৪০-৫০জন নৌ-কমান্ডো এবং ২০০ স্থলবাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। | ||||||
আশাশুনি এবং চাপড়া রাজাকার ও মিলিশিয়া ঘঁাটি দখলের পর মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ওয়ার বুলেটিনে লেখা হয়,According to a delayed report received from Khulna, MB launched a series of attack on the Pakistani troops in Chakulia and Mollahat Police Station on Oct.26. On the same day freedom fighters captured Razakars along with 17 Rifles in Ashasuni and Chapra area of the District.(তথ্য : লে: গাজী মো. রহমতউল্লাহ বিপি, খিজির আলী বীরবিক্রম শেখ আ. কাইয়ুম)। | ||||||
আশাশুনি থানা ও চাপড়া রাজাকার ঘঁfটি পুন:আক্রমণ : | ||||||
অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বার আশাশুনি থানার দখল গ্রহণ করলেও পরদিন পাকবাহিনীর জঙ্গি হেলিকপ্টারের ছত্রচ্ছায়ায় শত্রু সৈন্যরা পুনরায় আশাশুনি থানা ও চাপড়া ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং মুক্তিবাহিনীর পিছু হটে সুন্দরবনে আশ্রয় গ্রহণ করে । তখন থেকে তাদের সুতারখালী সন্নিকটে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ১৫-২০ ফুট উচুতে মাচা করে সেখানে অবস্থান করতে হয় । কিছুদিন পর সাবমেরিনার লে: রহমতউল্লাহ, মেজর আরেফিন ও খিজির আলী তঁাদের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে হেতালবুনিয়া এবং হাতিরডাঙ্গা ক্যাম্প পুন:প্রতিষ্ঠা করে অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেন । | ||||||
২৫ অক্টোবর এই কমান্ডোর নেতৃত্বে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং নৌ-কমান্ডো সমন্বিতভাবে আশাশুনি থানা পুনরায় আক্রমণ করেন; কিন্তু এখানে দুই কোম্পানি রেঞ্জার্স, রাজাকার প্রধান সড়ক এবং নদীর কিনারে বঁা ধের পাশ দিয়ে শতাধিক বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ খুড়েঁ রাখে । তারা এক বাঙ্কার থেকে ট্রেঞ্চের অভ্যন্তর দিয়ে প্রতিটি বাঙ্কারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে । বাঙ্কারগুলোর ওপর বাঁশ ও টিন ফেলে তার উপর মাটির মোটা আচ্ছাদন দিয়ে রাখে । বর্ষায় মাটিতে ঘাস জন্মানোর ফলে বাঙ্কারগুলোকে নির্দিষ্ট করাও কঠিন হয়ে পড়ে । | ||||||
২৫ অক্টোবর রাত আটটায় ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং নৌ-কমান্ডোর সমন্বয়ে আশাশুনি থানা আক্রমনের জন্য হেতালবুনিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে রওনা হন । রাত ১২টায় থানাকে ঘিরে তিনদিক থেকে আক্রমণ রচনা করা হয়। কিন্তু শত্রু সৈন্যরা এমনভাবে সুসজ্জিতছিল যে, মুক্তিবাহিনী তঁাদের ফঁাদে আটকে যায় । প্রবল গোলাগুলির মাঝে নৌ-কমান্ডো আ. সাত্তার এবং গেরিলা যোদ্ধা আবদুল মজিদ আহত হন । গুলি সাত্তারের উরুর মাঝখান দিয়ে দু’পা ভেদ করে চলে যায় । আ. মজিদও মারাত্মকভাবে আহত হন । ফলে নেতৃবৃন্দ কভারিং ফায়ার দিতে দিতে পিছু চলে আসেন। আহত দুজনকে চিকি..সার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয় । যুদ্ধাহত আবদুস সাত্তার এখন তাবানী বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেড চাকরি করেন । | ||||||
এই যুদ্ধে অংশ নেন কমান্ডো আলী আশরাফ, বজলুর রহমান, খলিলউল্লাহ, সৈয়দ আকরাম, আরজ আলী, মাহফুজুল হক, জিএমএ গাফ্ফার, বিশ্বনাথ পালিত, আ. হাকিম, শেখ সেলিম, নূরুল ইসলাম, জবেদ আলী, জিএমএ রহিম, ইমাম বারী, এমদাদুল হক, আ: জলিল, প্রফুল্ল, সুবোধ কুমার, শমসের আলী, মুজিবর রহমান, শেখ আ. কাদের, জবেদ আলী, হুমায়ুন কবীর, যোয়াদুর রসূল, আলফাজউদ্দিন, ডা. রুহুল হক, শফিক আহমদ, আ. সাত্তার, জহুরুল হক, মনসুর আহমদ মাঝি, রুহুল আমিন, গোলাম মোস্তফা, এ. মালেক, আমিনুর রহমান, সামসুল হক ও আ. হামিদ ( সাক্ষা..কার গ্রহণ: হুমায়ুন কবীর, আলফাজউদ্দিন, বজলূর রহমান, আ. গফুর, আলি আশরাফ, আবদুস সাত্তার)। | ||||||
চাড়পা রাজাকার ঘঁfটি পুনর্দখল : | ||||||
২৯ অক্টোবর এই দল আরও সুসজ্জিত হয়ে আশাশুনি থানার পার্শ্ববর্তী নদীর বিপরীত পাড়ে চাপড়া গ্রামে পাকবাহিনীর দোসর আতিয়ার এবং মতিয়ারের বাড়িতে অবস্থানকারী রাজাকার ঘাটির উপর প্রচন্ড আক্রমন পরিচালনা করেন । রাজাকাররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রতিরোধ ছাড়াই অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে আত্নরক্ষা করে । কয়েকজন ধরা পড়ে । ৩১ অক্টোবর প্রচুর গুলি ও ১৫টি রাইফেলসহ ১৫ জন রাজাকার হেতালবুনিয়া ক্যাম্পে সাবমেরিনার লে: রহমতউল্লাহ বীর প্রতীকের কাছে আত্নসমর্পণ করে । এর আগেও বেশ কিছু সংখ্যক প্রায় ২০০ রাজাকার আত্মসমর্পণ করেছিল । সাবমেরিনার লে: রহমতউল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের মাঝে ৬০ জনকে কমান্ডো বজলুর রহমান ও শফিক আহমেদ হাতিরডাঙা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী পুকুরে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করেন । কিন্তু তাদের কোন নৌ-যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি । তবে আত্মসমর্পণকারী রাজাকার এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে । তাদের একটি তালিকা আছে ।(তথ্য: জিএমএ রহিম বজলুর রহমান ও জিএমএ গফ্ফার) । | ||||||
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাতক্ষীরা জেলার গৌরবোজ্জ্বল অবদান আছে । ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উজ্জীবিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে সকল কলেজে ট্রেনিং এর পর ভারতে উন্নত আর্মস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুজিব বাহিনী/মুক্তিবাহিনী গঠন করে অসংখ্য যুদ্ধ পরিচালিত করা হয় । মুজিবনগর স্থাপিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থ বাবদ কয়েক কোটি টাকা সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধারা প্রদান করেন । সাতক্ষীরার অসংখ্য যুদ্ধের মধ্য সাতক্ষীরার পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দেয়া ও দেবহাটার টাউন শ্রীপুরের যুদ্ধের কথা উল্লেখযোগ্য । ৭ই জুন ১৯৭১ দেবহাটার টাউন শ্রীপুরের ঐতিহাসিক যুদ্ধে শহীদ হন কাজল, নাজমুল, নারায়ণ এবং আহত/পঙ্গু হন এরশাদ হোসেন খান চৌধুরীহাবলু ছাড়া আরও অনেকে । গণনাট্য পরিবেশনা দল মুক্তিযোদ্ধা/জনতা কে যুদ্ধে সাহস জোগা, যেখানে তারিক আনাম খান, খায়রুল বাসার, এনামুল হক বিশ্বাস অবদান রাখেন । সাতক্ষীরা জেলার সমগ্র মুক্তি সংগ্রাম/যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মেজর এম.এ জলিল, লে: রহমতউল্লাহ, মো: কারুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী, ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টার, মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম খান, আবদুল মুয়িদ খান চৌধুরী দুলু, মনসুর আহমেদ, আবু নাসিম ময়নাসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাতক্ষীরাবাসী চিরদিন স্মরণ রাখবে । | ||||||
থানাওয়ারী উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ বা গণহত্যারসংক্ষিপ্ত বর্ণনা : | ||||||
সাতক্ষীরা সদর থানা : | ||||||
২০ এপ্রিল ১৯৭১ : পাকবাহিনী প্রথম সাতক্ষীরাতে আসে । আসারসময় যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের ঝাউডাঙ্গা বাজারে তাদের কনভয় পৌঁছলে ভারতগামী এক বিশাল শরনার্থী দলের ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে । তাতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু হতাহত হয়। | ||||||
২১ এপ্রিল ১৯৭১ : পাকসেনারা সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে (বর্তমানে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) আশ্রিত শরণার্থীদের মধ্য থেকে অধিকাংশকেপার্শ্ববর্তী দিনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে । একই দিনে শহরের কাটিয়া এলাকার অ্যাড. কাজী মসরুর আহমেদ ( ক্যাপ্টেন কাজী)এর দ্বিতল বাড়ির পূর্বাংশ ধ্বংস করে এবং তাকে ও তার শ্যালক শেখ মাসুদার রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী সুলতানপুর কুমোরপাড়ায় একই পরিবারের তিন ব্যক্তিতে হত্যা করে এবং শেখ মশির আহমেদএর বাড়ি ধ্বংস করে এবং উক্ত বাড়ির সন্মুখে সাতক্ষীরা সিলভার জুবিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাতক্ষীরা কোর্টের মোহরারপুণ্য শাহকে গুলি করে হত্যা করে। | ||||||
২৯ এপ্রিল ১৯৭১ : সাতক্ষীরা সীমান্তের ভোমরায় পাকবাহিনীর সঙ্গে নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার আইয়ুব আলি।১৬-১৭ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার শামসুল হক ও দেবহাটার আবুল কাশেমসহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়াতে শহীদ আবুল কাশেমের নামে একটি পার্ক তৈরী করা হয়েছে। | ||||||
জুন ১৯৭১ :৭ জুন টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ সাতক্ষীরা মুক্তিযুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম।দেবহাটা উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে টাউন শ্রীপুর গ্রামে ক্যাপ্টেন শাহাজানমাস্টারের নেতৃত্বে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রাম করছিলেন। তারা প্রায় সবাইযুদ্ধক্লান্ত ছিলেন। ভোর রাতে স্থানীয় একজন মোয়াজ্জেম ফজরের নামাজ শেষেমুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে খান সেনাদের ক্যাম্পে খবর দেয়। খান সেনারা এসেমুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ শুরু করে। এই ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধেশামছুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আবেদীন খোকন, নারায়ন চন্দ্র হোড়, ইঞ্জিনিয়ারআবুল কালাম আজাদ সহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন এরশাদ হোসেন খানচৌধুরী হাবলু ও আব্দুর রশিদ, কানাইদিয়া। স.ম. বাবর আলী এ যুদ্ধে সাহসীভূমিকা পালন করেন। | ||||||
নভেম্বর ১৯৭১ : নভেম্বর মাসের কোনো এক রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউস ধ্বংস করার লক্ষ্যে কাঁটাতারের বেড়া কেটে সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এবং ইঞ্জিনরুমে দুটো বোমা পুতে রাখে । কিছুক্ষণ পরে বোমা দুটো বিষ্ফোরিত হলে পাওয়ার হাউসের ইঞ্জিন ধ্বংস হয় ।নেতৃত্ব দেন শেখ আব্দুল মালেক সোনা। | ||||||
কলারোয়া থানা : | ||||||
৩০ এপ্রিল ১৯৭১ : মাহমুদপুর, মুরারিকাটি, বামনখালি, নাথপুরপ্রভৃতি গ্রামে খান সেনারা হত্যাযঞ্জ, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুটতরাজ করে । | ||||||
জুলাই ১৯৭১ : ৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কলারোয়ার ভেতর দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে পাকবাহিনীর হাতে ধরাপড়ে । ২জন ছাত্র পালাতে পারলেও ৩ জনকে তারা নির্মমভাবে গুলি করে মারে । ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাদের কবর পাকা করে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে । | ||||||
২৭ আগষ্ট ১৯৭১ : হিজলদিতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খন্ডযুদ্ধ হয়, যা হিজলদি যুদ্ধনামে খ্যাত । যুদ্ধেবেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় । | ||||||
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ : কাকডাঙ্গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয় । দু’দিনব্যাপী কাকডাঙ্গা যুদ্ধে উভয়পক্ষ ভারী কামানসহ আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে । যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয় । তবে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন । | ||||||
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ : বালিয়াডাঙ্গায় পুনরায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয় । যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হলেও ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন এবং ৩ জন ধরা পড়েন । | ||||||
তালা থানা : | ||||||
২৫ এপ্রিল ১৯৭১ : পাটকেলঘাটা বাজারে একদল শরণার্থীসহ বহু মানুষকে একসঙ্গে পাকসেনারা হত্যা করে। ঘটনাটি পাটকেলঘাটাগণহত্যা নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। | ||||||
১৬ আগষ্ট ১৯৭১ : খানসেনাদের খাদ্য বোঝাই একটি লঞ্চ কপোতাক্ষনদ দিয়ে যাওয়ার সময় জালালপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা সেটি আক্রমণ করে । তারই প্রতিশোধ নিতে খানসেনারা জালালপুর গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং বহু মানুষকে হত্যা করে । | ||||||
২০ নভেম্বর ১৯৭১ : মাগুরায়, তালামুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি খন্ডযুদ্ধ হয় ।খবর পেয়ে আরও পাকসেনা যেয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং মুক্তযোদ্ধারাও প্রস্তুতি নেয় । এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিসেনা শহীদহন এবং কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী পাকসেনাদের গুলিতে মারা যায় । | ||||||
আশাশুনি থানা : | ||||||
১৫ আগষ্ট ১৯৭১ : ১৪ আগষ্ট ১৯৭১ তারিখে নৌ-মুক্তিবাহিনীর একটি দল মংলা বন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি অস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ মাইন দ্বারা ক্ষতি করে । ১৫ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাযোগে ভারত ফেরবার পথে বুধহাটায় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সাতক্ষীরা শহরের মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামও আফতাব উদ্দীন (বাগআছড়া)শহীদ হন এবং কয়েকজন ধরা পড়েন। শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামে সাতক্ষীরা শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। | ||||||
১৬ আগষ্ট ১৯৭১ : কেয়ারগাঁতি গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর তীরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনা ও রাজাকারদের কয়েক ঘন্টা সম্মুখযুদ্ধ হয় । যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে । | ||||||
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ : গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয় । বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত গোয়ালডাঙ্গা যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকার অস্ত্রসহ ধরা পড়ে । বাকিরা পলিয়ে যায় ।মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন শহীদ হন। | ||||||
৩০ অক্টোবর ১৯৭১ : মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপড়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে । যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয় । | ||||||
দেবহাটা থানা : | ||||||
২২ এপ্রিল ১৯৭১ : খানসেনারা প্রথমবারের মতো সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ যায় । যাওয়ার পথে পারুলিয়অতে অজিয়ার রহমান নামক এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে । ফেরার পথে বাজারের বেশ কিছু দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। | ||||||
১৫ আগষ্ট ১৯৭১ : সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের অন্যতম যোগসূত্র পারুলিয়া সাপমারা খালের উপর নির্মিত পুরনো কাঠের পুলটি ধ্বংসের জন্য ৯ সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. মাহফুজ আলম বেগ এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সফল অভিযান চালায় । অভিযানে পুলটি ক্ষতিগ্রস্তহয় । | ||||||
অক্টোবর ১৯৭১ : সাব-সেক্টর কমান্ডার মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শাঁকরা-কোমরপুর পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে । প্রচন্ড যুদ্ধে ৫-৬ জন খানসেনা নিহত হয় । কুলিয়া গ্রামের গোলজার হোসেন যুদ্ধে শহীদ হন । ঘটনাটি ভাতশালা যুদ্ধ নামে খ্যাত । | ||||||
২১ নভেম্বর ১৯৭১ : কুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা, লে. মাহফুজ আলম বেগ ও মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে । যুদ্ধে ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন এবং বহু পাকসেনা নিহত হয় এবং ঘাঁটি ফেলে পালায় । | ||||||
কালিগঞ্জ থানা : | ||||||
১৩ জুন ১৯৭১ : সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূরুল হুদার নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাবসন্তপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলেযুদ্ধ হয় । যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা মারা পড়ে এবং বহু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের করায়ত্ত হয় । | ||||||
জুলাই ১৯৭১ : খানজিয়া বিওপি ক্যাম্পের দখল নিতে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয় । যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়ে পালায় এবং ৪ জন আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। | ||||||
২৮ জুলাই ১৯৭১: উকশা সীমান্তেমুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকসেনা প্রাণ হারায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পড়ে খানসেনারা জীবন দেয় বলে ঘটনাটি ‘উকশার মরণ ফাঁদ’ নামে পরিচিতি। |
কালিগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধকালিন মহরা |
|||||
৪ সেপটেম্বর ১৯৭১: পিরোজপুর গ্রামে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করতে আসা পাকবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বহু পাকসেনা ও রাজাকার মারা পড়ে। | ||||||
২৬ সেপটেম্বর ১৯৭১: সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. মাহফুজ আলম বেগ ও কমান্ডার শেখ ওয়াহেদুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কালিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে তাদেরকে আত্মসর্মণে বাধ্য করে। একই দিনে কালিগঞ্জ বাজারে অবস্থিত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কালিগঞ্জ শাখা (বর্তমান সোনালী ব্যাংক) অপারেশন করে ব্যাংকের বেশ কয়েকটি বন্দুক হস্তগত করে।
২০নভেম্বর ১৯৭১: কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনিতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছু হটে। তবে বেশ কিছু পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বুন্দি হয়। দিনটি কালিগঞ্জ বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। |
||||||
শ্যামনগর থানা: | ||||||
গাবুর নৌ-যুদ্ধ : | ||||||
৬ মে ১৯৭১: দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করতে সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিলসহ ৯ সেক্টরের নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাগণের একটি দল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অস্ত্রভর্তি দুটো লঞ্চ নিয়ে যাওয়ার পথে গাবুরায় পাক নৌবাহিনীর গানবোটের মুখে পড়ে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় এবং তাদের লঞ্চে পাকসেনাদের গোলার আঘাতে আগুন ধরে যায়। তারা নদী তীরে নেমে পড়লে ‘পিস কমিটি’র লোকের হাতে তারা ধরা পড়েন। মেজর এম.এ জলিলসহ কেউ কেউ কৌশলে পালাতে সক্ষম হলেও ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। | ||||||
১৯ আগষ্ট ১৯৭১ (২ ভাদ্র ১৩৭৮): গোপালপুরে পাকসেনা ও রাজাকারদের সাথে মুক্তিসেনাদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ১৮ আগষ্ট দিবাগত রাতে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করলে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। গোপালপুরে তাদের কবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। | ||||||
৯ সেপটেম্বর ১৯৭১ (২৩ ভাদ্র ১৩৭৮): ৩ সেপটেম্বর কয়েকজন খানসেনা হরিনগর স্কুলে যায়। খবর পেয়ে এলাকার শিকারি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নবাব্দি ফকির তার দলবল নিয়ে পাক গানবোটের ওপর আক্রমণ করে। তাতে গানবোটের কিছুটা ক্ষতি হয় এবং পাকসেনারা ফিলে যেতে বাধ্য হয়। অতঃপর ৯ সেপটেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা প্রতিশোধ নিতে হরিনগর বাজার ঘেরাও করে ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনাটি হরিনগর গণহত্যা দিবস হিসেবে ইতিহাসে লিখিত রয়েছে। | ||||||
১২ অক্টোবর ১৯৭১: ভেটখালির রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেয়। | ||||||
এমনি করে খন্ড খন্ড সশস্ত্র যুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবলপ্রতিরোধে ৭ ডিসেম্বর পাকসেনারা সাতক্ষীরা ছেড়ে চলে যায়। মুক্ত হয় সাতক্ষীরা । দীর্ঘ নয় মাস ধরে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা, এদেশের মুক্তি। | ||||||
প্রতি বছর ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়। | ||||||
দীর্ঘ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা জেলার বহু নিরীহ মানুষ পাকবাহিনী ও তাদেরদোসর রাজাকার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে হত্যা হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন স্থানেগণকবর দেয়া হয়। এসব বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে মাহমুদপুর (সাতক্ষীরা সদর), সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয়ের পিছনে, বাঁকাল ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বে, ঝাউডাঙ্গা বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে গোবিন্দকাটি মাঠে, পার কুমিরা, জালালপুর, হরিনগর ও বিনেরপোতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। |